প্রতিবাদ ১
মিষ্টিভাষি
টিভি তে দেখে শিখেছিলাম, শিশুশ্রমিক রাখা একটা অপরাধ। সেই কারনে কোন এক মফস্বল এলাকায় একটা শিশুকে চা দোকানে কাজ করতে দেখে দোকানদারকে অপরাধী বলে মনে হয়েছিল। ছেলেটার নাম ধরেনিননা রাম, শ্যাম, রহিম বা অন্য কিছু। বয়স মাত্র দশ বছর। চা দোকানের এঁটো গ্লাস ধুচ্ছে, খরিদ্দারদের চা দিচ্ছে। মনে হল এই বয়সের ছেলেরা পড়াশোনা করে, মা-বাবার সাথে আনন্দ করে। কথাটা মনে হতেই নিজের মধ্যে একটা প্রতিবাদ করার প্রবল ইচ্ছা জেগে উঠল। প্রতিবাদ করলাম ও। আমার দেখা দেখি আরও কিছু আমার মতো খরিদ্দারও তাই করল। আমাদের প্রতিবাদ দেখে বাচ্চা ছেলেটা দৌড়ে দোকানদারের পাশে গিয়ে দাঁড়াল। তার চোখে মুখে আতঙ্কের ছাপ। দোকানদারকে দেখলাম নিরুত্তাপ। বাচ্চাটাকে বলতে শুনলাম, "ভয় পাসনা, আমি তো আছি"। আমার মাথা আরো গরম হয়ে গেল। এতটাই গরম যে আর একটু হলে দোকানদার কে মেরেই দিতাম। দোকানদার হাঁসি মুখে আমায় বলল," একটা কাজ করুন। আপনাকে ওর বাড়ির ঠিকানা দিচ্ছি, গিয়ে দেখে আসুন। তারপরও যদি আপনার মনে হয় আমি ভুল করছি, তাহলে তো আমি আর আমার দোকান রইলই, যা ইচ্ছে হয় করবেন।" ঠিকানাটা যখন আমার হাতে দিল, দেখলাম সেটার সত্যতা যাচাই করার জন্য আমার পাশে আর কেউ নেই। সবাই পালিয়েছে যে যার কাজে। কিছুমুহুর্ত প্রতিবাদ পরিণত হয়েছে পলায়নে। কিন্তু আমি ঠিক করে নিলাম এর শেষ দেখেই ছাড়বো।
দোকানের পাশেই রাস্থায় দাঁড়ান একটা রিক্সাকে ঠিকানাটা বলে উঠে পড়লাম। কিছুক্ষণ পর পৌঁছিয়ে গেলাম নির্দিষ্ট ঠিকানায়। দোকানদারের বলে দেওয়া নির্দেশ অনুযায়ী একটু এগিয়ে যেতেই পেয়ে গেলাম বাচ্চাটার বাড়ি। বাড়ি বলাটাকি ঠিক হবে? বাঁশের খুঁটির উপরে দাঁড়িয়ে টালির বাড়ি। টালির ভেঙ্গে যাওয়া অংশ থেকে জল ও রোদ আটকানর জন্য লাগানো হয়েছে বড় বিজ্ঞাপনের ব্যানার। ভিতরে ঢুকতে আর ইচ্ছে করল না। আসে পাশের কিছু লোকজনের থেকে বাচ্চাটার কিছু তথ্য সংগ্রহ করলাম। যে তথ্য আজও আমার জীবনে একটা করুন সংগ্রহ হয়ে রইল। তথ্যটা এই রকম- বাচ্চাটার বাবা ছিলেন রঙের মিস্ত্রি। কোলকাতায় এক ঠিকাদারের কাছে কাজ করতেন। বাচ্চাটার বয়স যখন আড়াই বছর, সেই সময় একদিন কলকাতা থেকে খবর আসে বাচ্চাটার বাবা কোন এক বাড়িতে রঙ করার সময় ভারা ভেঙ্গে পড়ে গিয়ে মারা জান। এই ঘটনার মাস তিন পর বাচ্চাটার মাও কোন এক ব্যাক্তির হাত ধরে বাচ্চাটাকে তার ঠাকুরমার কাছে রেখে চলে যায় নতুন সংসার পাততে। আর ফিরে আসেনি। এখন এই বাড়িতে বাচ্চা ও তার বয়স্কা ঠাকুরমা আছেন। সেই বয়স্কাও বয়সের দরুন চোখে দেখতে পায় না। ঐ বাড়িতে একমাত্র উপার্জন করার মত ব্যাক্তি ঐ বাচ্চাটা।
চায়ের দোকানটায় আর ফেরা হল না। সারাটা সময় বাচ্চাটার কথাই মাথায় ঘুরছিল। বাড়ি ফেরার পথে সঙ্গি রইল কেবল চোখের কোণে কয়েক ফোঁটা নোনাজল। এর পরেও কি প্রতিবাদ করা সম্ভব?
(ক্রমশ)